গরিব দেশের হাতেও অত্যাধুনিক অস্ত্র, জোগান দিচ্ছে কে?

গরিব দেশের হাতেও অত্যাধুনিক অস্ত্র, জোগান দিচ্ছে কে?
‘রাজনীতি যদি রক্তপাতহীন যুদ্ধ হয়, তাহলে যুদ্ধ হল রক্তপাতের রাজনীতি।’

আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি এবং সংঘাত পরিস্থিতিতে ঘুরে ফিরে উঠে আসে মাও জেদংয়ের এই উক্তি। রাজনীতি এবং যুদ্ধকে পাশাপাশি বসালে বেরিয়ে আসে স্বার্থসিদ্ধির আখ্যানও। খাতায় কলমে এই মুহূর্তে দু’টি যুদ্ধ চলছে, রাশিয়া বনাম ইউক্রেন এবং ইজরায়েল বনাম প্যালেস্তাইনের হামাস। পাশাপাশি, আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত। গৃহযুদ্ধ চলছে লিবিয়া, ইয়েমেনেও। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ কিছু দেশ এবং বিশেষ কিছু সংস্থা কার্যতই ফুলেফেঁপে উঠছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সংঘাতে জর্জরিত দেশগুলিতে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে তারা। (Top Arm Exporting Countries)

২১টি অলাভজনক সংস্থাকে নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা Oxfam চলতি বছরের গোড়ায় একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৮৫০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি হয়েছে, ভারতীয় মুদ্রায় যা ৭, ০৮, ৬৪৫ কোটি টাকা। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, চিন এবং জার্মানি এই বিপুল পরিমাণ আয় করেছে, যারা কিনা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে আনা, নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে যারা সওয়াল করে রাষ্ট্রপুঞ্জে। এই পাঁচটি দেশই এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা পাঁচ অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। (International Weapon Market)

নিউইয়র্কে Oxfam-এর প্রধান ব্রেন্ডা মোফিয়ার মতে, আন্তর্জাতিক মহলে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’র বার্তা দিলেও, আসলে নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধে ইন্ধন জোগাচ্ছে এই দেশগুলি। তাদের তৈরি বন্দুক-বোমার আঘাতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছেন। বোমা-গুলির আঘাত যদিও বা এড়াতে পারছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অনাহারে মৃত্যু ঘটছে কাতারে কাতারে মানুষের। Oxfam জানিয়েছে, এক দশক আগের সঙ্গে তুলনা করলে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালে গোটা পৃথিবীতে অস্ত্রের জোগান বেড়েছে ৪.৮ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে ৪৮ হাজার নিরীহ মানুষ মারা গিয়েছেন। গৃহহীন হয়েছেন ৯ কোটি মানুষ। শুধুমাত্র ২০২২ সালেই ১৯টি দেশ মিলিয়ে ১১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের ঠাঁই হয়েছে চরম ক্ষুধার্তের তালিকায়।

সামরিক খাতে খরচ বাড়িয়েছে প্রত্যেক দেশই

এই সময়কালের মধ্যে সামরিক শক্তির খাতে খরচ-খরচা বাড়িয়েছে প্রায় প্রত্যেক দেশই। শুধুমাত্র ২০২২ সালেই পৃথিবীর তাবড় দেশ মিলিয়ে সামরিক খাতে ২.২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, ভারতীয় মুদ্রায় যা ১,৮৩,৪১,৪০০ কোটি টাকা। দক্ষিণ সুদানের মতো দেশেও ২০২২ সালে সামরিক খাতে খরচ বাড়ে ৫০ শতাংশ। অথচ সেদেশে মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ নাগরিকই অনাহারে বেঁচে রয়েছেন। এ বছর মার্চ মাসে, স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) যে রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়, বিদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করে ভারত (১১ শতাংশ)। এর পর রয়েছে সৌদি আরব (৯.৬ শতাংশ), কাতার (৬.৪ শতাংশ), অস্ট্রেলিয়া (৪.৭ শতাংশ), চিন (৪.৭ শতাংশ), মিশর (৪.৫ শতাংশ), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৭ শতাংশ), পাকিস্তান (৩.৭ শতাংশ) এবং জাপান (৩.৫ শতাংশ)।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ এবং সংঘাতপর্ব চলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে তার জন্য অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ এবং সংস্থাগুলিকেই দায়ী করেন পোপ ফ্রান্সিস। নিজেদের মুনাফার স্বার্থে কিছু মানুষ যুদ্ধ পরিস্থিতি জিইয়ে রাখছেন বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর এই দাবি যে অমূলক নয়, তা অক্টোবর মাসে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের একটি রিপোর্টে উঠে আসে। তাতে দেখা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধে আমেরিকা থেকে অস্ত্র সরবাহ অভূতপূর্ব হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, স্মার্ট বম্ব, অ্যামিউনিশন এবং ইজরায়েলের আয়রন ডোম মিসাইল-ডিফেন্স সিস্টেমে ব্যবহৃত ইন্টারসেপ্টরের চাহিদা একধাক্কায় বেড়ে গিয়েছে।

অস্ত্র বিক্রির বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য আমেরিকার

নিউইয়র্ক টাইমসের ওই রিপোর্টে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রের চাহিদা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে পেন্টাগন এবং বেসরকারি অস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিকে। এশিয়া থেকেও প্রচুর অস্ত্রের বরাত এসেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার জোগান দিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ২০২২ সালের যে হিসেব সামনে এসেছে, তাতে পৃথিবীর অস্ত্রশস্ত্র বিক্রির যে বাজার রয়েছে, তার ৪৫ শতাংশই দখল করে রয়েছে আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে অস্ত্রশস্ত্রের বাজারে আর কোনও দেশের এই একচেটিয়া আধিপত্য দেখা যায়নি।আমেরিকার কংগ্রেসে পেন্টাগন যে নথি জমা দিয়েছে, সেই অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশের সরকারের তরফে পাওয়া অস্ত্রের বরাতে ভর করে, চলতি বছরের প্রথন ন’মাসেই তাদের বিক্রিবাটা ৯০.৫ বিলিয়ন ডলারের অঙ্ক পার করে গিয়েছে, গত এক দশকে এই অঙ্ক ছিল ৬৫ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকার যে সমস্ত সংস্থা এই অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে, সেই তালিকায় একেবারে শীর্ষে রয়েছে লকহিড মার্টিন।

অস্ত্র বিক্রির বাজারের এই রমরমা দেখে অনেক ছোট দেশও দৌড়ে নাম লিখিয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তুরস্ক এবং দক্ষিণ কোরিয়া, যাতে জোগানে ঘাটতি দেখা দিলে, তাদের কপাল খোলে। এ প্রসঙ্গে অলাভজনক সংস্থা Arms Control Association-এর বোর্ড সদস্য মাইকেল ক্লেয়ার বলেন, “ক্ষণভঙ্গুর পৃথিবীতে বাস করছি আমরা। বহু অমীমাংসিত সংঘাত রয়েছে। তবে যে হারে অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে, তাতে আঞ্চলিক সংঘাত বাড়বে বই কমবে না।” এ প্রসঙ্গে ভারত-পাকিস্তান, আর্মেনিয়া-আজেরবাইজান সংঘাতের উল্লেখ করেন তিনি।

অস্ত্র বিক্রির বাজারের বর্তমান সমীকরণ

রাশিয়া পাকিস্তানকে অস্ত্রের জোগান দিতে শুরু করায়, ভারতও এই মুহূর্তে আমেরিকার থেকে অস্ত্র কিনতে শুরু করেছে। চিনের পরিবর্তে আমেরিকার দ্বারস্থ হয়েছে ইন্দোনেশিয়াও। রাশিয়ার থেকে সুখোই যুদ্ধবিমান কিনতে উদ্যোগী হয়েছিল তারা। কিন্তু পরে ওই চুক্তি থেকে সরে আসে এবং ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি করে। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে পোল্যান্ড ৪১.৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র কিনতে উদ্যোগী হয়েছে আমেরিকার থেকে। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে গত বছরই ১৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করে তারা। ওই চুক্তির আওতায় ১০০০ ট্যাঙ্ক, ৪৮ যুদ্ধবিমান এবং ৬৭২টি স্বচালিত হাউইৎজারের বরাত দেয় তারা। লিবিয়া, সিরিয়া, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, আজেরবাইজান-সহ ২৯টি দেশকে ড্রোন সরবরাহ করছে তুরস্ক।

জো বাইডেনের আমলে ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, তাইওয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একাধিক দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে আমেরিকা। একে তাইওয়ানই ১৯ বিলিয়ন ডলারের বরাত দিয়েছে তাদের। প্রত্যেক বছর ইজরায়েলকে ৩০০ কোটি ডলারের অস্ত্রশস্ত্র এমনিতেই সরবরাহ করে আমেরিকা। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে, ১০০০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য চেয়েছে ইজরায়েল। সৌদি আরব আমেরিকাকে ১৬৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার বরাত দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে সওয়ালকারী জেফ অ্যাব্রাহামসন বলেন, “ইতিহাস সাক্ষী অস্ত্রব্যবসা সব সময়ই অপ্রত্যাশিত ফলাফল বয়ে আনে। আমরা ভুলে যাই যে, অস্ত্রশস্ত্র দীর্ঘদিন মজুত করে রাখা যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা ভুল লোকজনের হাতে গিয়ে পড়ে।”

অতি সম্প্রতি আমেরিকার কংগ্রেসে একটি রিপোর্ট জমা পড়ে, যাতে বলা হয়, রাশিয়া এবং চিনের মতো দেশ লাগাতার তাদের সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে, আগামী দিনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নেমে এলে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাদের মোকাবিলা করতে হলে নিজেদের সামরিক শক্তি, বিশেষ করে পরমাণু শক্তিতে আরও ধার দিতে হবে আমেরিকাকে। পেন্টাগনের তরফে অস্ত্র বিক্রির বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েমের যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তার নেপথ্যে ওই রিপোর্টের ভূমিকাও রয়েছে বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল।

(Feed Source: abplive.com)