সন্দীপ সরকার, কলকাতা: ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ট্রফি হাতে উৎসব করছেন টম ল্যাথাম, ডারিল মিচেলরা। ভারতকে সর্বকালীন লজ্জা উপহার দিয়ে (India vs NZ)। দেশের মাটিতে প্রথমবার টেস্ট সিরিজে ০-৩ হোয়াইটওয়াশ হয়েছে ভারত। কিউয়ি ক্রিকেটারদের সঙ্গে ট্রফি নিয়ে সেলিব্রেট করেছেন আরও একজন। ভারতের মাটিতে ভারতের দর্পচূর্ণ করার নেপথ্যে তাঁরও হাত রয়েছে যে!
শুনলে অনেকে চমকে উঠতে পারেন যে, ল্যাথাম-মিচেলদের সঙ্গে বিজয়োৎসবে সামিল এক ভারতীয়ও। আদ্যোপান্ত বঙ্গসন্তান। নিউজ়িল্যান্ড শিবিরকে শারীরিকভাবে চাঙ্গা রাখার দায়িত্ব ছিল যাঁর কাঁধে। নিজের কাজ সাফল্যের সঙ্গে সেরেছেন। কিউয়িদের উৎসবে তাই তিনিও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে।
অতনু ঘোষ। নামটা অনেকের কাছেই অজানা হতে পারে। কিন্তু বাঙালি তরুণের সাফল্যের মুকুটে এমন কিছু রঙিন পালক রয়েছে যে, ঈর্ষা করতে পারেন ক্রিকেট বিশ্বের তাবড় তারকারাও।
রঞ্জি ট্রফি, বিজয় হাজারে ট্রফি, ইরানি কাপ, আইপিএল, ভারতকে ভারতের মাটিতে ৩-০ হোয়াইটওয়াশ করে জেতা ট্রফি – ক্রিকেট বিশ্বের একের পর এক কোহিনূর।
কে এই অতনু ঘোষ?
পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। হুগলির মশাটে বাড়ি। বাবা মিষ্টির দোকানে কাজ করেন। অভাব আর নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে সেই অতনুই এখন ক্রিকেটের ময়দানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। অন্তরালে থেকেই যিনি মাঠের সাফল্যে অবদান রেখে চলেছেন।
অতনু পেশাদার ম্যাসিওর। ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে নিউজ়িল্যান্ড শিবির নিয়োগ করেছিল তাঁকে। নিজের কাজ দিয়েই সকলের মন জিতে নিয়েছেন বাঙালি তরুণ।
ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের অভিজ্ঞতা কেমন? টেস্ট সিরিজ শেষ হয়ে গেলেও এখনও নিউজ়িল্যান্ড দলের সঙ্গে মুম্বইয়ে আছেন অতনু। মঙ্গলবার পর্যন্ত কিউয়ি ক্রিকেটারেরা মুম্বইয়েই থাকছেন। সেখান থেকেই সোমবার মোবাই ফোনে এবিপি আনন্দকে অতনু বললেন, ‘খুব ভাল অভিজ্ঞতা। আন্তর্জাতিক টেস্ট দলের সঙ্গে প্রথমবার কাজ করলাম। তবে নিউজ়িল্যান্ড শিবির আমার পরিচিত। ওয়ান ডে বিশ্বকাপের সময়ও ওদের সঙ্গে ছিলাম। সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল নিউজ়িল্যান্ড। তবে টেস্ট সিরিজ জেতার আলাদা আনন্দ। তার ওপর ভারতকে ভারতের মাটিতে ৩-০ হারানো, আলাদা আনন্দ তো হচ্ছেই।’
ভারতে খেলতে আসার আগেই অতনুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল কিউয়ি শিবির। কীভাবে হল নিউজ়িল্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ? ‘কলকাতা নাইট রাইডার্সে টিম সাউদি, লকি ফার্গুসনরা ছিলেন। ওঁরা আমাকে দেখেছেন। ওঁরাই ওয়ান ডে বিশ্বকাপের সময় যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়কার কাজ দেখেই টেস্ট সিরিজের জন্য চুক্তি করা হয়েছে আমার সঙ্গে,’ বলছিলেন অতনু। নিউজ়িল্যান্ড দলে একা ম্যাসিওর অতনু। তাঁর কাজ দেখে খুব খুশি কিউয়ি শিবির।
ম্যাসিওর হওয়া কীভাবে? অতনু বলছেন, ‘আমি ক্রিকেট খেলতাম না। পড়াশোনার জন্য শিয়ালদার কোলে মার্কেটে থাকতাম। ডিন্ডাদা (অশোক ডিন্ডা), পাপালিদারাও (ঋদ্ধিমান সাহা) থাকত। আমার সেরকম কোনও ধারণা ছিল না। কয়েকজন ক্রিকেটারই বলে একটা ফিজিওর কোর্স আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর আমি বাংলা সাহিত্য নিয়ে তখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছিলাম। কিন্তু ফিজিওর কোর্স করতে গেলে সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড লাগত যা আমার ছিল না। তখন ম্যাসিওরের কোর্সের কথা জানতে পারি। এটা করতে মাধ্যমিক পর্যন্ত সায়েন্স থাকলেই হবে। তখন একটি ইনস্টিটিউট থেকে কোর্স করলাম।’
সেই কোর্স শেষ হওয়ার পরেই কালীঘাট ক্লাবের কর্ণধার বাবলু কোলে ও বাচ্চু কোলে ক্লাবের হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন। অতনুর কথায়, ‘আমাকে ওঁরা বলেন, তুমি কালীঘাট ক্লাবের ম্যাসিওর হিসাবে কাজ করো। সেই শুরু। তারপর ইডেনে দেড়শো বছর উপলক্ষ্যে টুর্নামেন্ট হয়। কর্নাটক খেলতে এসেছিল। ওদের একজন ম্যাসিওর লাগত। বাংলার ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্ল যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। লক্ষ্মীদার মাকে আমার মা দেখাশোনা করত। সেই সূত্রে যোগাযোগ। কর্নাটক দলের হয়ে সেই টুর্নামেন্টে কাজ করি। আমার কাজ ভাল লাগায় ওরা পাকাপাকিভাবে দলে যোগ দিতে বলে। আমার পড়াশোনা ততদিনে শেষ। আমি রাজি হয়ে যাই।’
কর্নাটকে ২০১৪ থেকে ২০১৫ – দু’বছরের মধ্যে রঞ্জি ট্রফি, বিজয় হাজারে ট্রফি ও ইরানি কাপ জেতেন অতনু। ২০১৭ সাল পর্যন্ত কর্নাটকের সঙ্গে কাজ করেছেন। অতনু বলছেন, ‘ওখানে থাকার সময় কর্নাটক প্রিমিয়ার লিগ, তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগেও কাজ করি। তারপর ভারত এ, অনূর্ধ্ব ১৯ ভারতের সঙ্গেও কাজ করি। বাংলাদেশের সঙ্গে যেবার ফাইনালে হারল ভারত, আমিই ছিলাম টিম ইন্ডিয়ার ম্যাসিওর। ২০২০ সাল থেকে কলকাতা নাইট রাইডার্সে রয়েছি।’
সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কী? অতনু বলছেন, ‘রঞ্জি ট্রফি আমার জেতা প্রথম ট্রফি। এই ওয়াংখেড়েতেই জিতেছিলাম। ফের এই মাঠেই সিরিজ জিতলাম। গতবার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। অনেক ভাল মুহূর্তই রয়েছে।’
ভারতের মাটিতে ভারতীয়দের প্রতিপক্ষ শিবিরের হয়ে কাজ করতে অস্বস্তি হয়নি? অতনুর গলায় পেশাদারিত্ব। বলছেন, ‘কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করেনি। আমি তো আমার দলকেই দেখব। ভারতীয় দলে তিনজন ম্যাসিওর আছে।’
অতনুর বাড়িতে রয়েছে মা, বাবা, ভাই, স্ত্রী ও মেয়ে। মেয়ের বয়স মাত্র ১৫ মাস। সামনে কোনও টুর্নামেন্ট নেই। কেকেআর ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে আইএল টি-২০তেও কাজ করেন অতনু। তবে কেকেআরের সঙ্গে চুক্তি হয় শুধু আইপিএলের সময়।
ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ অগ্নিপরীক্ষা ছিল, মনে করেন অতনু। বলছেন, ‘ভারতে ক্রিকেটকে ধর্ম মনে করা হয়। সেখানে সফল হয়ে আলাদা রোমাঞ্চ তো আছেই। তবে কাজটা চ্যালেঞ্জিংও। সকলের চোট আঘাতের খেয়াল রাখা। পেশির সুস্থতার খেয়াল রাখা। স্নায়ু যাতে সতেজ থাকে নিশ্চিত করা, সব দেখতে হয়।’ যোগ করলেন, ‘মুম্বইয়ে খুব গরম ছিল। ক্রিকেটারদের বারবার জলপানের বিরতি নিতে হচ্ছিল। নিউজ়িল্যান্ড দেশ থেকেই ড্রিঙ্কস সাপ্লিমেন্ট নিয়ে এসেছিল। সেটা আমরা বানাই। প্রত্যেক ক্রিকেটারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ থাকে। প্রত্যেক দিন লাঞ্চ ব্রেকে আইস বাথ করাতে হতো। গরমে পেশির টান ধরেছে অনেক ক্রিকেটারের। মুম্বইয়ে ডারিল মিচেলের পেশিতে টান ধরেছিল, পুণেতে মিচেল স্যান্টনারের ক্র্যাম্প হয়েছিল। ওদের সল্ট ওয়াটার দিতে হয়েছে। টান লাগা পেশিগুলো রিলিজ করার জন্য ম্যাসাজ করেছি। ওদের ফিট করে তুলতে পেরেছি।’
অতনুর সাফল্যে বাড়ির সকলে খুশি। মুম্বই থেকে কলকাতা হয়ে মশাটেই ফিরবেন। কলকাতায় ফ্ল্যাট নিয়েছেন? সরল গলায় অতনু বললেন, ‘কলকাতায় আসলে এখনও আমি কোলে মার্কেটেই থাকি।’ মাটিতে পা রেখেই চলতে চান বঙ্গসন্তান।
(Feed Source: abplive.com)