ভাষিণী: ভারতের নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অতিক্রান্ত ভাষা ব্যবধান! জেনে নিন

ভাষিণী: ভারতের নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অতিক্রান্ত ভাষা ব্যবধান! জেনে নিন

#নয়াদিল্লি: নানা ভাষা নানা মতের দেশ ভারতবর্ষ। বিবিধের মাঝে মহান মিলনের ঐতিহ্য তার দীর্ঘ বছরের। কিন্তু তার ভিতরেই লুকিয়ে আছে ব্যবধানের বীজও। অন্য প্রদেশের ভাষা বুঝতে না পারার সমস্যা। আর সেই সমস্যায় সব থেকে বেশি জর্জরিত এ দেশের স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টাতেই খানিক দূর অগ্রসর হতে চাইছে কেন্দ্র।

কেন্দ্রীয় সরকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (NLP) সংস্থানগুলিকে পাবলিক ডোমেনে MSME (Macro, Small and Medium Enterprises), স্টার্টআপ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগীদের জন্য এই ‘ভাষিণী’ (Bhashini) প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে।

‘ভাষিণী’র মাধ্যমে দেশের যে কোনও প্রান্তের নাগরিকদের তাঁদের মাতৃভাষায় দেশের ডিজিটাল উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন। এতে ক্ষুদ্র উদ্যোগীদের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতায়ন হবে বলে দাবি। এটি দেশের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমকে ত্বরান্বিত করবে বলেও আশা করা হচ্ছে। কারণ এটি ‘ইন্টার-অপরেবল’ (Interoperable) একটি ব্যবস্থা।

শুধু তাই নয় এর ফলে দেশে বিভিন্ন প্রদেশের নাগরিককে তাঁদের নিজস্ব প্রাদেশিক ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে উৎসাহিত করবে। কেন্দ্রের দাবি এর ফলে যে শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগীদের ব্যবসা বাড়বে তাই নয়, এই বিভিন্ন ভাষায় তৈরি হওয়া বিষয়বস্তু একত্রিত করা গেলে তা কেন্দ্রীয় শাসন ও নীতির ক্ষেত্রেও উপকারী হবে। লাভ হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-সহ নানা জনস্বার্থের ক্ষেত্রে।

এর আগেই ইলেকট্রনিক্স এবং আইটি মন্ত্রক (Ministry of Electronics and IT) বলেছিল: ‘এই বিশেষ প্রকল্পটি ভারতীয় ভাষায় উদ্ভাবনী পণ্য এবং পরিষেবাগুলির বিকাশ এবং প্রতিস্থাপনে একত্রিত ভাবে কাজ করবে। যা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারী সংস্থা এবং স্টার্ট-আপগুলিকে জড়িয়ে একটি বাস্তুতন্ত্র তৈরি করবে ও তা প্রতিপালন করবে।’

মন্ত্রক আরও দাবি করেছে যে, ‘ভাষিণী’-র বহুভাষিকতা আদতে উপকারই করবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। এই উদ্যোগের ফলে তাঁরা তাঁদের সৃষ্টিশীল মন এবং পণ্যগুলিকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন। দেশের প্রায় প্রত্যেক নাগরিকের কাছেই পৌঁছে যাবে যে কোনও প্রান্তের কোনও হস্তশিল্প।

তাই সরকারের মতে, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, ব্যক্তিগত তথ্য সংস্থান এবং ডিজিটাল ক্ষমতায়নের পথ করে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এর আগে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া সপ্তাহ ২০২২’ পালন করে কেন্দ্র। সে সময় তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব (Ashwini Vaishnaw) তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন:

‘ভাষিণী এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে যার দ্বারা এক ভাষায় কথা বলা লোকেরা অন্য যে কোনও ভাষায় কথা বলা মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন সহজে।’

দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের ক্ষেত্রেও প্রবল আত্মবিশ্বাসী ভারত সরকার। এ বিষয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি যে ভাষিণী যা আজ ভারতীয় ভাষার জন্য তৈরি করা হয়েছে তা বিশ্বের অন্য ভাষার জন্যও একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে।’

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময়, তিনি শ্রোতাদের মধ্যে বসা আধিকারিকদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ভাষিণী দেখুন, এটি ব্যবহার করুন, নতুন সমাধান তৈরি করুন এবং এটিকে একটি নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ার পথে সামিল হোন।’

ভাষিণী নিয়ে এ বছরের শুরু থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে ভারত সরকার। চলতি বছরের মে মাসে, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রক ‘মিশন ডিজিটাল ইন্ডিয়া ভাষিণী’ নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে যাতে দেশের বিশিষ্ট স্টার্টআপগুলিকে উৎসাহিত করা যায় সে বিষয়ে নীতি নির্ধারণের রূপরেখা তৈরির চেষ্টা করা হয়। বিশেষত যে সব স্টার্টআপ ভারতীয় ভাষা ডোমেনে (Domain) কাজ করছে তাদের নিয়েই এই বিশেষ সম্মলনের আয়োজন করে হয়েছিল৷ সেখানে উপস্থিত হয়েছিল প্রায় ৭৩টি ভারতীয় স্টার্টআপ সংস্থা। তাদের সঙ্গে কথা বলেন ভারতের ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি এবং দক্ষতা উন্নয়ন এবং শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী (Minister of State for Electronics and Information Technology and Skill Development and Entrepreneurship) রাজীব চন্দ্রশেখর (Rajeev Chandrasekhar)।

ওই বৈঠকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ভাষা প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা উদ্ভাবন, বিকাশের পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহারে স্টার্টআপগুলির বড় ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি। স্টার্টআপগুলি আমাদের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মিশন ডিজিটাল ইন্ডিয়া ভাষিণীর মাধ্যমে আমরা ভারত-নির্দিষ্ট এবং ভারতীয় ভাষায় পারঙ্গম তথ্য প্রযুক্তির দিকগুলি বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন দেব৷ আশা করি এটি আরও বেশি সংখ্যক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ভাষা ভিত্তিক স্টার্টআপগুলিকে এগিয়ে আনবে।’

ভাষিণী কী ভাবে কাজ করে?

ভাষা সংক্রান্ত কাজের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এখানে নিজেদের অবদান রাখা যেতে পারে।

‘ভাষিণী’ মিশনে অবদান রাখতে হলে:

১. প্রথমেই নিজের স্মার্টফোনের ‘প্লে স্টোর’ (Play Store) থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড কর নেওয়া যেতে পারে। অথবা, সরাসরি bhashini.gov.in-এ গিয়েও খোঁজ করা যায়।

২. একবার ডাউনলোড হয়ে গেলে, অ্যাপের মধ্যেই দেখা যাবে একটি অপশন— ‘Jion Bhasha Daan’

৩. কোনও ব্যবহারকারী এই ‘Jion Bhasha Daan’ অপশনে ক্লিক করতে পারেন। সেখানে এটি চারটি অংশগ্রহণের বিকল্প দেখানো হবে— সুনো ইন্ডিয়া, বোলো ইন্ডিয়া, লিখো ইন্ডিয়া এবং দেখো ইন্ডিয়া।

৪. Suno India- ব্যবহারকারী অডিও-য় কিছু শুনতে পাবেন। যা শুনেছেন তা টাইপ করে এবং অন্যদের দ্বারা প্রতিলিপিকৃত পাঠ্য যাচাই করে অংশগ্রহণ করতে পারেন।

৫. Bolo India- বাক্যটি রেকর্ড করে এবং অন্যদের দ্বারা রেকর্ড করা অডিও যাচাই করে কোনও নাগরিক ভয়েস অবদানের সময় অংশগ্রহণ করতে পারেন।

৬. Likho India- এই বিকল্পটি ব্যবহার করে যে কোনও যোগদানকারী তাঁর ভাষায় প্রম্পটেড টেক্সট অনুবাদ করতে পারেন এবং অন্যদের দ্বারা অবদানকৃত অনুবাদগুলিকে প্রত্যয়িত করতে পারেন।

৭. Dekho India: এখানে একটি ছবিটিকে লেবেল করে এবং অন্যদের দ্বারা লেবেল করা ছবি যাচাই করে অবদান রাখা যেতে পারে।

অ্যাপটি যখন কোনও ব্যবহারকারী খুলবেন এবং এই বিভাগগুলির মধ্যে যে কোনও একটি নির্বাচন করে পরবর্তী প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করবেন, তখনই অ্যাপের তরফ থেকে প্রত্যুত্তর দেওয়া হবে। ভাষা অবদানের জন্য একটি “ভাষা সমর্থক” ব্যাজ প্রদান করা হবে। ওই পেজ (Page)-এ দেখা যাবে কোনও একটি নির্দিষ্ট ভাষা এখনও পর্যন্ত কত শতাংশ অবদান রাখতে পেরেছে।

ভাষিণীতে পাওয়া তথ্য অনুসারে, এই নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত, ‘সুনো ইন্ডিয়া’ (Suno India)-তে ৮৭০ জনের বেশি মানুষ যোগ দান করেছেন, অন্যদিকে ‘বোলো ইন্ডিয়া’ (Bolo India), ‘লিখো ইন্ডিয়া’ (Likho India) এবং ‘দেখো ইন্ডিয়া’ (Dekho India)-তে যথাক্রমে ৫৪৪, ৪৪৯ এবং ৫৪২ জন অংশগ্রহণ করেছেন।

এটি ফেসবুক (Facebook), লিঙ্কডইন (Linkdin), ট্যুইটার (Twiter) এবং হোয়াটসঅ্যাপ (Whatsapp)-এ শেয়ার করার জন্য অপশনও থাকছে। শেয়ার করা হলে একটি বার্তায় জানান হবে, ‘আমি https://bhashini.gov.in/bhashadaan/en/-এ ভারতের জন্য উন্মুক্ত ভাষা সংগ্রহস্থল তৈরিতে অবদান রেখেছি। আসুন ভাষাদানে অবদান রেখে আমাদের ভাষাকে ক্ষমতায়ন করে একটি পার্থক্য তৈরি করি।’

ভাষা ব্যবধান কমিয়ে ফেলার পথ

ঠিক কেন এত বছর পর এমন একটি প্লাটফর্মের প্রয়োজন হল নানা ভাষা নানা মতের দেশ ভারতে? Bhashini.gov.in ওয়েবসাইটটিতে স্পষ্ট ভাবে এর উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, ‘এটি আসলে একটি ঐকতান, যেখানে সরকার, শিল্পক্ষেত্র, শিক্ষাক্ষেত্র, গবেষণা গোষ্ঠী এবং স্টার্ট-আপগুলিকে এক সুরে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হবে, যাতে সমস্ত ক্ষেত্রের অবদানকে এক উন্মুক্ত ভাণ্ডারে একত্রিত করে রাখা যায়।’

সরকার ভারতীয় ভাষাগুলিকে ডিজিটাইজ করার জন্য একটি পরিমাপযোগ্য সমাধান তৈরি করতে একাধিক স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে চায়।

ভাষিণীর ইকোসিস্টেমে আটটি প্রধান বিভাগ রয়েছে:

কেন্দ্র/রাজ্য সরকারগুলি: মিশনের উদ্দেশ্যগুলি অর্জনের জন্য ভাষা-নির্দিষ্ট প্রচেষ্টার সঙ্গে ভাষিণীকে সারিবদ্ধ করা।

ভাষা মিশন: তথ্য উৎস সনাক্ত করা, তথ্য সংগ্রহ করা, সামগ্রী তৈরি করা এবং ক্রাউডসোর্সিং উদ্যোগের পরিকল্পনা করা ও সম্পাদন করা।

একাডেমিয়া এবং রিসার্চ গ্রুপ: ভাষা প্রযুক্তিতে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে নিয়োজিত।

স্টার্টআপ: বহুভাষিক অ্যাপ্লিকেশন এবং পরিষেবাগুলি বিকাশ করা।

শিল্প: ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার বিকাশ করা, সঞ্চয়স্থান সরবরাহ করা এবং প্রশিক্ষণ মডেলগুলির জন্য কম্পিউটিংয়ে অবদান রাখা।

ডেটা সংগ্রহ এবং কিউরেশন কোম্পানি: তথ্যাবলি সংগ্রহ, যাচাই এবং কিউরেট।

প্রকাশক: তথ্যাবলি এবং মডেল তৈরি করতে ডেটা উৎস সরবরাহ করা।

ব্যক্তি: ক্রাউডসোর্সিং উদ্যোগের মাধ্যমে ভাষিণীতে অবদান রাখা।

Published by:Ananya Chakraborty

(Source: news18.com)