আজকের ব্যস্ততার যুগে সঠিক ডায়েট মেনে না চলা, চটজলদি খাবারের ওপরে ভরসা, অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড গ্রহণ, অত্যাধিক শর্করাযুক্ত খাবার ইত্যাদি কারণে আমাদের গড়পড়তা শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত অবনতির দিকে এগিয়ে চলেছে। এর সঙ্গেই রয়েছে দ্রুত শারীরিক ওজন বৃদ্ধি ও নানা রোগের হাতছানি। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ১৬ বছর বা ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের কারণে নানা রোগের জন্ম নিচ্ছে। চিকিৎসকরা বার বার বিভিন্ন পরিবারগুলিকে এই বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ কার্ডিওলজির (European Society of Cardiology) প্রকাশনায় ইউরোপীয় হার্ট জার্নালে হার্টের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারা একটি গবেষণায় ঐকমত্য নির্বিশেষে কিছু সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়েছে। ওই জার্নালে ইতালির নেপলস ফেদেরিকো আই১ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট অথার অধ্যাপক জিওভানি ডি সিমোন (Giovanni de Simone) জানিয়েছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে বাবা-মায়েরাই শিশুদের স্বাস্থ্য আচারের পরিবর্তনে বা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য এজেন্ট’। তিনি আরও বলেন যে, ‘প্রায়ই দেখা যায় উচ্চ-রক্তচাপ বা ওজন বৃদ্ধির মতো সমস্যাগুলি জিনগত ভাবেই একই পরিবারের মধ্যে দেখা যায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হবে যে পারিবারিক ভাবে এই অবস্থানের পরিবর্তন করতে চাইলে সমগ্র পরিবারকেই একত্রে জীবনযাত্রার আচরণ ও মান পরিবর্তন করতে হব।‘
বিভিন্ন সময়েই চিকিৎসকেরা বাচ্চাদের উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য খাদ্যতালিকায় তাজা শাক-সবজি, ফল এবং অন্যান্য উচ্চ-ফাইবার যুক্ত খাবারগুলি রাখাই ভালো মনে করছেন। অন্য দিকে, নুন যুক্ত খাবার, মিষ্টি সফট ড্রিঙ্কস, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ইত্যাদিকে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। শিশু এবং কিশোরদের প্রতিদিন অন্তত দুই ঘন্টার বেশি শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম করানো যেতে পারে। তবে এর বেশি নয়। প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘন্টা জোরালো শারীরিক ক্রিয়াকলাপ যেমন জগিং, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা ইত্যাদিতে সক্রিয় থাকা উচিত।
প্রফেসর ডি সিমোন অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়েছেন যে, যে সব বাচ্চারা টিভি দেখতে বা তাদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে ভালোবাসে, তারা কতটা সময় এই কাজে ব্যয় করছে এবং তাদের সক্রিয় ভাবে অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত রাখা যায় কি না তাতে নজর রাখতে হবে।
ওজন, ডায়েট এবং ব্যায়ামের জন্য বাস্তবসম্মত ক্ষেত্রগুলিতে ফোকাস করা উচিত। প্রফেসর ডি সিমোনের মতে, তরুণরা এবং তাদের পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্যদের ওজন, খাওয়ার ধরন এবং শারীরিক কার্যকলাপের দীর্ঘমেয়াদী রেকর্ড রেখে তাদের অগ্রগতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এরপর সেই মতো ডায়েট গ্রহণ ও নিয়ম মেনে চলা উচিত। একে ‘হেলথ প্রোমোটিন রিওয়ার্ড সিস্টেম’ বলে। এর পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটনো, পারিবারিক সম্পর্ককে মজবুত ইত্যাদিও স্বাস্থ্য বিষয়ক মান উন্নয়নে সহায়তা করে।
ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, শৈশবকালের স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপ যথাসময়ে নিয়ন্ত্রণ না করে হলে তা পরবর্তীতে আরও প্রকট আকারে ধরা দেবে। শৈশবের উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা বিশেষ করে পেটের স্থূলতায় এই সমস্যা আরও বেশি। অধ্যাপক ডি সিমোনের মতে, ‘শৈশবকালীন উচ্চ রক্তচাপের বৃদ্ধি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় কারণ এর থেকে পরবর্তীতে কার্ডিওভাসকুলারের মতো সমস্যা তৈরি হয়’। উচ্চ রক্তচাপ প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা অপরিহার্য যাতে জীবনধারায় পরিবর্তন আনা যায় এবং প্রয়োজনে ওষুধের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সাধারণত ডাক্তার বা নার্সরা একবার দেখলেই রক্তচাপ বা ওজন বৃদ্ধির মতো সমস্যা বুঝতে পারেন, তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার দেখিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। ডি সিমোন বলেছেন, ‘যাদের মধ্যে এই সমস্যা রয়েছে তাদের বছরে অন্তত একবার স্ক্রিনিং করা উচিত। কারণ বাচ্চাদের উচ্চ রক্তচাপ ঠিক প্রাপ্তবয়স্কদের মতো নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তা উপসর্গবিহীন’। মেডিকেল হিস্টরি বা শারীরিক পরীক্ষা করেই এক্ষেত্রে রোগ নির্ধারণ করা সম্ভব। জন্মের সময়ের ওজন, গর্ভকালীন বয়স, উচ্চ রক্তচাপ এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের পারিবারিক ইতিহাস, ধূমপান, নুনযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যেস, অ্যালকোহল ব্যবহার, শারীরিক কার্যকলাপ, মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, মাথা ঘোরা, কম দৃষ্টিশক্তি, দুর্বল শরীরের মতো সম্ভাব্য লক্ষণগুলি এই সব রোগ নির্ধারণে সহায়তা করে।
মেডিসিন নেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, যেমন, কম ডোজের ওষুধ দিয়ে শুরু করা, তার পর তা অকার্যকর হলে ওষুধের ডোজ অল্প বাড়ানো ইত্যাদি। এছাড়া পারিবারিক দায়িত্ব হিসাবে বাচ্চাদের টিভি দেখার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া, অস্বাস্থ্যকর খাবার বাড়িতে আনা বন্ধ করা, ক্ষতিকারক জীবনধারার পরিবর্তন ঘটানো ইত্যাদি মেনে চলা উচিত।