সমুদ্রগর্ভের বৃষ্টি অরণ্য, বাস্তুতন্ত্রের প্রহরী, উষ্ণায়নে রঙিন প্রবাল বিবর্ণ, মরণাপন্ন

সমুদ্রগর্ভের বৃষ্টি অরণ্য, বাস্তুতন্ত্রের প্রহরী, উষ্ণায়নে রঙিন প্রবাল বিবর্ণ, মরণাপন্ন

ওয়াশিংটন: শুধুমাত্র সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধিই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে ভারসাম্য হারাতে পারে বাস্তুতন্ত্রও। দীর্ঘ দিন ধরে সেই সতর্ক করে আসছেন পরিবেশবিদরা। টুকরো-টাকরা প্রতিশ্রুতি ছাড়া বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনও হেলদোল চোখে পড়েনি এখনও পর্যন্ত (Global Temperatures)। কিন্তু এই উদাসীনতা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের রক্ষাকর্তা, প্রবালদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা (Ocean Life)। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির জেরে প্রবালেরা বিবর্ণ এবং ফ্যাকাশে হয়ে পড়ছে এবং তাদের আয়ু কমছে বলে উঠে এল গবেষণায়। (Coral Reefs)

উদাহরণস্বরূপ আমেরিকার সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা প্রবাল প্রাচীরের উল্লেখ করছেন বিজ্ঞানীরা। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সেখানে সমুদ্রের জলের উষ্ণতা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছে। তাতে বিবর্ণ হতে শুরু করেছে প্রবালেরা। স্বভাবতই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদরা। গ্রীষ্মের গোড়াতেই সাগর-মহাসাগর-সমুদ্রের জলের উষ্ণতা যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে প্রবাল প্রাচীরগুলির কতদিন সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন গবেষকরা।

বিজ্ঞানীর জানিয়েছেন, মানুষের মতো প্রবালদেরও গরম সহ্য করার ক্ষমতা সীমিত। সমুদ্রের জলের উষ্ণতা এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে একটা সময় পর আর বিবর্ণ হওয়া নয়, একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে প্রবাল। কারণ সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বাড়লেও, ঠান্ডায় আশ্রয় নিতে গভীরে যেতে পারে না প্রবালেরা। ফলে উষ্ণ জলেই দিন-রাত কাটে তাদের। সেই সহ্যের সীমা যে কোনও দিন পেরোতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।

সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্যই নয় শুধু, রূপের জন্যও পরিবেশপ্রেমীদের কাছে প্রবাল অত্যন্ত প্রিয়। লাল, সিঁদুরে লাল, বেগুনি, নীল, সবুজ, নানা রংয়ের প্রবাল রয়েছে গোটা বিশ্বে। কিন্তু জল যত উষ্ণ হয়, ততই বিবর্ণ হতে শুরু করে তারা। উষ্ণ জলের সংস্পর্শে তাদের কোষে বসবাসকারী শৈবাল খসে পড়়তে শুরু করে। এতে ফ্য়াকাশে এবং বিবর্ণ হতে শুরু করে প্রবালেরা। পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘কোরাল ব্লিচিং’ বলা হয়। এতে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু না হলেও, ধকল শুরু হয় শরীরে, যা ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় প্রবালকে।

২০০৫ সালে ক্য়ারিবিয়ান সাগরে এই ‘কোরাল ব্লিচিং’-এর জেরেই অর্ধেক প্রবাল প্রাচীর হারায় আমেরিকা। ভার্জিন আইল্যান্ড এবং পুয়ের্তো রিকো-সহ দক্ষিণ অংশের প্রবাল প্রাচীরগুলি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে ২০ বছর আগের পরিস্থিতির সঙ্গে তৎকালীন পরিস্থিতির ফারাক স্পষ্ট ফুটে ওঠে। তবে শুধু তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই নয়, তাপমাত্রার ওঠাপড়াও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় প্রবালদের।  ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ফ্লোরিডায় জলের তাপমাত্রা একধাক্কায় -৬.৭ ডিগ্রিতে নেমে যায়। তাতেও প্রচুর প্রবাল মারা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে তাপমাত্রার এই ওঠাপড়া, পরিবেশের খামখেয়ালিপনা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর, অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্য়ারিয়ার কোরাল রিফ, যা কিনা ওয়র্ল্ড হেরিটেজ অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক, ১৯৯৮ সাল থেকে সেখানে ছ’দফায় ‘কোরাল ব্লিচিং’ হয়েছে। ২০২২  সালে এল নিনোর প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় সেখানে। এবছরও এল নিনো ঘিরে ঝুঁকি রয়েছে।

প্রবলকে সমুদ্রগর্ভের বৃষ্টিঅরণ্য বলে উল্লেখ করেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রবাল প্রাচীরের আলিঙ্গনেই বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং আশ্রয়। মাছ এবং মানুষের খাদ্যযোগ্য সামুদ্রিক প্রাণীদেরও বেড়ে ওঠাও এই প্রবাল প্রাচীরকে ঘিরে, যার উপর অর্থনীতিও নির্ভরশীল। এই প্রবাল প্রাচীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘিরে গড়ে উঠেছে কোটি কোটি টাকার পর্যটন শিল্পও। শুধু তাই নয়, উপকূল, সমুদ্রসৈকত এবং তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা পরিকাঠামোকেও ধরে রাখে প্রবাল প্রাচীর।

সেই প্রবাল প্রাচীর নিঃশেষ হয়ে গেলে, গোটা বিশ্বের জন্য ক্ষতি। কারণ প্রবালের মৃত্যু হওয়ার অর্থ, তাদের বংশবৃদ্ধিও ব্যাহত হওয়া। এর ফলে উপকূল এবং সমুদ্রসৈকতগুলির জলে তলিয়ে  যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শুধু আমেরিকা নয়, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, পানামা, অস্ট্রেলিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্য অঞ্চলেও প্রবাল প্রাচীর গুলি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে। তাই এখনও টনক না নড়লে কিছু করার থাকবে না বলে আশঙ্কা পরিবেশবিদদের।

(Feed Source: abplive.com)