সরকার-ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসেবে অধীরও, ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ বিশেষ কমিটি কেন্দ্রের

সরকার-ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসেবে অধীরও, ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ বিশেষ কমিটি কেন্দ্রের
নয়াদিল্লি: পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি কার্যকর করতে তৎপর কেন্দ্র। তার জন্য সেপ্টেম্বরে সংসদে পাঁচ দিনের বিশেষ অধিবেশনও বসছে। তার আগে এই সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি গঠন করা হল। দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে ওই কমিটির শীর্ষে রাখা হয়েছে। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী, কংগ্রেস ত্যাগী গোলাম নবী আজাদ, বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা তথা প্রাক্তন IAS অফিসার এনকে সিংহ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ তথা লোকসভা সেক্রেট্যারিয়টের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সুভাষ কাশ্যপ, প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল হরিশ সালভে এবং সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের প্রাক্তন কমিশনার সঞ্জয় কোঠারি।

শুক্রবার এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি কার্যকর করা, তার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলি খতিয়ে দেখতে এবং তা নিয়ে পর্যালোচনা করতেই এই কমিটি গড়া হয়েছে বলে খবর। ‘এক দেশ, এক নীতি’ কার্যকর করতে এই নিয়ে চতুর্থ কমিটি গড়া হল। এর আগে, আইন কমিশন, নীতি আয়োগ এবং সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করে। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশ এই চতুর্থ কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমে প্রহ্লাদ বলেন, “আপাতত শুধু একটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি নিয়ে পর্যালোচনা চলবে। ওই কমিটি যে রিপোর্ট জমা দেবে, তা জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে এবং সেই অনুযায়ী চলবে তর্ক-বিতর্ক চলবে। বিষয়টি আলোচনার জন্য তোলা হবে সংসদেও। এখনই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধুমাত্র আলোচনাই চলছে। আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের জননী হিসেবে পরিচিতি আমাদের। গণতন্ত্রের জননীর বুকে বিবর্তন ঘটছে।”

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন ঘিরে সব শিবিরে প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে, সেই সময় আচমকা সংসদের বিশেষ অধিবেশনের কী প্রয়োজন, ‘এক দেশ, এক নীতি’ কার্যকর করতেই বা এত তাড়াহুড়ো কেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছেন বিরোধীরা। তার পাল্টা প্রহ্লাদ বলেন, “জাতীয় স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে, এমন যে কোনও বিষয়ই গণতন্ত্রে আলোচনা সাপেক্ষ। তার অর্থ এই নয় যে, আজ বললেই কাল থেকে নয়া নীতি চালু হয়ে যাবে। আমরা তেমন কথা বলিনি।” তবে তাড়াহুড়ো যে হচ্ছে, তা বিজ্ঞপ্তি থেকেই স্পষ্ট। কারণ সরকারি বিজ্ঞপ্তিতেই বলা হয়েছে, ওই কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল। অবিলম্বে ওই কমিটির বৈঠক শুরু হতে চলেছে এবং যত শীঘ্র সম্ভব সুপারিশ জানাতে বলা হয়েছে।

‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি কার্যকরার দাবি যদিও নতুন নয়। ঢের আগে থেকেই এর সপক্ষে সওয়াল করে আসছে বিজেপি। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে কেন্দ্র এবং রাজ্যের নির্বাচন সংঘটিত হয়। কিন্তু ১৯৬৭ সাল থেকে এই নীতিতে পরিবর্তন আসে। রাজ্য এবং প্রদেশগুলির আঞ্চলিক সত্তা এবং সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর কথা মাথায় রেখেই পৃথক নির্বাচনের রেওয়াজ শুরু হয় সেই থেকে। কিন্তু ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, বিজেপি লাগাতার ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি কার্যকরের পক্ষে সওয়াল করে আসছে। নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তাকে সামনে রেখেই বিজেপি একসঙ্গে সব নির্বাচন করিয়ে সুফল ঘরে তুলতে চাইছে বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।

যদিও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ থেকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং বিজেপি বিরোধী শিবিরের নেতারা বরাবর এই সুপারিশের বিরোধিতা করে আসছেন। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় আইন কমিশন যখন এই সংক্রান্ত খসড়া রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতেও সাফ বলা হয় যে, দেশের বর্তমান সাংবিধানিক পরিকাঠামোয় ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি কার্যকর করা সম্ভব নয়। এর জন্য় সংবিধানে সংশোধন ঘটানো প্রয়োজন বলে জানানো হয়। ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি কার্যকর করতে হলে, ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, লোকসভা এবং বিধানসভার কার্যপ্রক্রিয়া সংক্রান্ত আইনেও সংশোধন ঘটাতে হবে বলে জানানো হয় খসড়া রিপোর্টে। দেশের সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৫০ শতাংশের সমর্থন প্রয়োজন বলেও জানানো হয়।

২০১৫ সালে সংদীয় স্ট্য়ান্ডিং কমিটির রিপোর্টও সংসদে তুলে ধরা হয়। তাতে ১৯৯৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্ট তুলে ধরে ‘এক দেশ, এক নির্বাচনে’র সপক্ষে সওয়াল করা হয়। তার জন্য বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আনার সুপারিশও করেন কমিটির সদস্যরা। সেক্ষেত্রে লোকসভার মোট সদস্য সংখ্যার দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন বলে জাাননো হয়। অন্যথায় অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে চার সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন করানোর কথা বলা হয়।

২০১৮ সালে নীতি আয়োগের একটি রিপোর্ট তুলে ধরা হয় লোকসভায়। তাতে দুই পর্যায়ে নির্বাচনের কথা বলা হয়। তবে সেক্ষেত্রেও সংবিধানে সংশোধন ঘটানোর কথা বলা হয়েছিল। আজ পর্যন্ত  কোনও সুপারিশই গ্রহণ করেনি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। এবার চতুর্থ কমিটি গঠন করল তারা। যদিও মোদি নিজে বরাবরই ‘এক দেশ, এক নির্বাচনে’র সপক্ষে সওয়াল করে আসছেন। ২০১৯ সালে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন, এক কর’ নীতি প্রণয়নের কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে। অন্য দলের রাজনীতিকদের সঙ্গেও সেই নিয়ে পরামর্শ করেন। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে আবারও ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’কে দেশের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। বার বার নির্বাচন করাতে গিয়ে উন্নয়নের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়, তার জন্যও ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি চালু করা দরকার বলে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসেও দাবি করেন মোদি। এতে খরচ বাঁচবে বলেও যুক্তি দেয় তাঁর সরকার।

কিন্তু ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’  নীতি কার্যকর করার নেপথ্যে আসলে বিজেপি-র রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বলে মত বিরোধী শিবিরের নেতা থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের। তাঁদের মতে, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে, কৌশলগত ভাবেই এই নীতির পক্ষে সওয়াল করছে মোদি সরকার এবং বিজেপি। এর মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যাগুলি নিয়েও জাতীয়তাবাদী হিড়িক তুলতে চায় বিজেপি। জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে মোদিকে সামনে রেখে রাজ্য তথা পঞ্চায়েত স্তরের মানুষকেও প্রভাবিত করতে চায় তারা, যাতে এক ঢিলেই দুই পাখি মারা সম্ভব হয়। ২০১৪ সাল থেকে উত্তর ভারতে বিজেপি-র দৌরাত্ম্য চোখে পড়লেও, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে একরকম ভাবে খাতাই খুলতে পারেনি বিজেপি। তাই সংবিধানে সংশোধন ঘটিয়ে, একবারে সর্বত্র ক্ষমতাদখলের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি, এমন দাবিও করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র অংশুল অভিজিৎ সংবাদমাধ্য়মে বলেন, “চলার পথে এই মুহূর্তে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে মোদিকে। I.N.D.I.A শিবির যেভাবে একজোট হয়েছে, আদানির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর নামও জড়িয়ে যাচ্ছে, সীমান্তে চিনা আগ্রাসনকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না, তার উপর বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং সর্বোপরি মণিপুর হিংসায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তাই প্রকাশ পাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখেই এখন ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি কার্যকর করার মরিয়া চেষ্টা শুরু হয়েছে।”

(Feed Source: abplive.com)